শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

এ-প্লাস ছাড়া ওদের আর কী দিচ্ছি

এম আর ইসলাম:

কয়েকদিন আগে এসএসসি’র ফলাফল বের হয়েছে, তাতে প্রায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। কোনো কোনো বোর্ডে পাসের হার ৯৫ শতাংশের বেশি। তিন লাখের কাছাকাছি শিক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এ-প্লাস পেয়েছে। অর্থাৎ এরা সব সাবজেক্টে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। কী মারাত্মক সফলতা আমাদের শিক্ষার্থীদের ও শিক্ষাব্যবস্থার! দেশ ও জাতির উন্নয়ন ঠেকায় এখন কে? এখন প্রশ্ন জাগে, কী এমন হলো যে গত ২০ বছরে, এদেশের সন্তানরা লেখাপড়ায় এমন অসামান্য ফলাফল করা শুরু করল? এদের এই সাফল্যের অংশীদার দেশ বা দেশের মানুষ কতটা হতে পারছে?

লেখাপড়ার মান বেড়েছে না কমেছে, সে তর্কে না গিয়ে, বোর্ড পরীক্ষার ফলে আমাদের বিস্মিত হওয়ার কাহিনী আজ গল্প করার মতো। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সব দিক থেকে আজ এ-প্লাস বা কাছাকাছি ফলের উদযাপন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে যাচ্ছে উচ্ছ্বাসে আর অভিনন্দনে। ৯০-এর দশকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলে যে নিশ্চিত তিন সাবজেক্টে ফেল করত, সেও কালের বিবর্তনে আজ উল্লেখযোগ্য রেজাল্টের মালিক। অভিভাবকরাও পুলকিত, আত্মহারা। যদিও, কোনো কোনো অভিভাবক তার সন্তানের এমন কৃতিত্বে কিছুটা সন্দিহান, কারণ সন্তানের মেধার মাত্রা আর পরিশ্রমের কাহিনী তো তার অজানা নয়।

যাই হোক, এই বিশাল সংখ্যার শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই এইচএসসিতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। তারও পরে অনেক এ-প্লাস শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা মাড়াতে ব্যর্থ হয়। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে যায়, তাদের কেউ কেউ আগের এ-প্লাস মার্কা ফলের সঙ্গে সংগতি রেখে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করতে পারে না। কোনো কোনো শিক্ষার্থী শুদ্ধভাবে বাংলা বা ইংরেজিতে একটা নির্ভুল প্যারাগ্রাফ লিখতে পারে না। অন্যদিকে যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় না, তারা তাদের ইগোর কারণে, সরকারি কলেজে পড়তে চায় না। তারা ভর্তি হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদেরই কল্যাণে নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাই ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারার মতো দামি এলাকায় ক্যাম্পাস রেখেও তাদের বাণিজ্য চালায় সগৌরবে।

লেখাপড়ার মতোই, মোবাইল আর ইন্টারনেট আসক্ত এই জেনারেশন তৈরি হচ্ছে অনেক মানসিক দৈন্য নিয়ে। সামাজিক আচার-ব্যবহারে এরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার এদের মধ্যে খানিকটাই অনুপস্থিত। এরা পড়তে বসে রাত ১০টার পরে, আর ঘুমতে যায় ভোর ৫টায়। এদের সকাল হয় বেলা ১২টায়। শেয়ারিং-কেয়ারিং ব্যাপারটা এদের মধ্যে নেই। এরা একটা ‘ভোগী’ প্রজন্ম। দায়িত্ব নিতে এরা শেখে না। পরিবারের সীমাহীন আদর আর প্রশ্রয়ে এরা কর্মবিমুখ আর কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে বেড়ে ওঠে। অনেকটা অনুভূতিহীন এরা। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহযোগিতা করার মানসিকতা এরা দেখায় না। কানে হেডফোন গোঁজা এই প্রজন্ম চারপাশের দুনিয়াকে অবহেলা করতে শিখে যায় অল্প বয়স থেকেই। এদের অনেকেই বিদেশে পড়তে গিয়ে, সেখানে স্থায়ী হতে চায়। পরিবার, দেশ, জাতি কোনো কিছুই তাদের খুব একটা টানে না। কোনো কিছুতেই এদের কিছু যায় আসে না।

গণ্ডায় গণ্ডায় এ-প্লাস দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাসহ জাতির ভবিষ্যতের বারোটা বেজেছে। অল্প পরিশ্রমে অধিক ফলপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা, পরবর্তী জীবনের কোনো দুর্বিপাক মানতে পারে না। এরা ক্ষেত্রবিশেষে অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তাই, যে কোনো পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার মানসিকতা এদের মধ্যে থাকে না। প্রকৃত মূল্যায়নে কোনো অপ্রত্যাশিত ফল হলে, হতাশা এদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করে। তাইতো, সম্প্রতি তরুণ সমাজের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, অতিমাত্রায় ইগো থাকার কারণে, এরা যে কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে না। পরিশ্রমী হতে এরা নারাজ। নিজেদের সুপারস্মার্ট ভাবা এসব তরুণরা, নিজেদের মেধা আর শ্রম দিয়ে আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়তে পারবে কিনা, সন্দেহ থাকে ঢের। এমনকি মানবিক বাংলাদেশ এদের দ্বারা বিনির্মাণ হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। পুঁথিগত শিক্ষার প্রভাবে, এরা প্রকৃত জ্ঞান এবং শিক্ষা অর্জন থেকে দূরে অবস্থান করে।

আসলে এমন দুরাশার জন্য, এই তরুণ প্রজন্মকে দায়ী করা যায় না। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের মূল্যবোধ সামগ্রিকভাবে কমেছে। বাবা-মা’রাও প্রকৃত অভিভাবকের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটা শিশুর ক্রমবিকাশে, বাবা-মায়ের যে ইতিবাচক ভূমিকা থাকা দরকার ছিল, সেটা তারা রাখতে পারেননি। সামাজিক মূল্যবোধ আর মানবিক গুণগুলো এই প্রজন্মের মধ্যে গ্রথিত করবার যে দায়িত্ব পরিবার আর বিদ্যালয়ের ছিল, সেটা যথাযথভাবে পালিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই অসৎ বাবা-মায়ের আচরণ সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এই দুর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশের অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত বাবা-মা যে অনেক ক্ষেত্রেই সততার পরিচয় দিতে পারেননি, এটা বলাই বাহুল্য। সম্পদ গড়তে মনোনিবেশ করা এই বাবা-মায়েরা অজান্তেই সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারেন না। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য পাহাড়সম সম্পদ রেখে যেতে গিয়ে, এরা সন্তানকে সম্পদ হিসেবে তৈরি করতে ভুলে যান।

সন্দেহ নেই যে, এদেশের এসএসসি বা এইচএসসি এবং সমমানের পরীক্ষাগুলোর ফলে সরকারের অনেক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ থাকে। অনেকের মুনাফার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়, এমন স্রোতে ভাসমান শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করার মাধ্যমে। তাই, সরকারের অচিরেই উচিত হবে এমন অতিমাত্রার এ-প্লাস মার্কা ফলের লাগাম টেনে ধরা। প্রকৃত মেধার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই রেজাল্ট হওয়া উচিত। ফেল করা শিক্ষার্থীকে পাস করানোর মধ্য দিয়ে, আমরা উচ্চশিক্ষায় ও কর্মসংস্থানের ওপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি করছি। পাশাপাশি, মানবিক দেশ ও সমাজ গঠনে, সামাজিক ও মানবিক বোধসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি করা উচিত। এক্ষেত্রেই পারিবারিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এসএসসি’র আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিলেও, নিশ্চিত করা উচিত যেন শিক্ষামূলক কার্যক্রম ছাড়া, অন্য কোনো ক্ষেত্রে যেন এর ব্যবহার না ঘটে। বাচ্চাদের জীবনযাপনেও কঠোর অনুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োগ ঘটানো উচিত। অতি আদুরে আর ভোগী জীবনে যেন তারা অভ্যস্ত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। ছোটবেলাতেই যেন অতি প্রাইভেসির দোহাই দিয়ে, অসামাজিক কার্যকলাপে এরা অভ্যস্ত হয়ে না পড়ে, সেটা যথেষ্ট বিবেচনায় রাখা উচিত।

লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION